শাস্তি
প্রথম
পরিচ্ছেদ
দুখিরাম রুই এবং ছিদাম রুই দুই ভাই সকালে যখন
দা হাতে লইয়া জন খাটিতে বাহির হইল তখন তাহাদের দুই স্ত্রীর মধ্যে বকাবকি চেঁচামেচি
চলিতেছে। কিন্তু, প্রকৃতির অন্যান্য নানাবিধ নিত্য কলরবের ন্যায় এই কলহ-কোলাহলও পাড়াসুদ্ধ
লোকের অভ্যাস হইয়া গেছে। তীব্র কণ্ঠস্বর শুনিবামাত্র লোকে পরস্পরকে বলে- “ওই রে বাধিয়া গিয়াছে ”, অর্থাৎ যেমনটি আশা করা যায়
ঠিক তেমনিটি ঘটিয়াছে, আজও স্বভাবের নিয়মের কোনোরূপ ব্যত্যয়
হয় নাই। প্রভাতে পূর্বদিকে সূর্য উঠিলে যেমন কেহ তাহার কারণ জিজ্ঞাসা করে না,
তেমনি এই কুরিদের বাড়িতে দুই জায়ের মধ্যে যখন একটা হৈ-হৈ পড়িয়া যায়
তখন তাহার কারণ নির্ণয়ের জন্য কাহারও কোনোরূপ কৌতূহলের উদ্রেক হয় না।
অবশ্য এই কোন্দল-আন্দোলন প্রতিবেশীদের অপেক্ষা
দুই স্বামীকে বেশি স্পর্শ করিত সন্দেহ নাই, কিন্তু সেটা তাহারা কোনোরূপ অসুবিধার মধ্যে
গণ্য করিত না। তাহারা দুই ভাই যেন দীর্ঘ সংসারপথ একটা এক্কাগাড়িতে করিয়া চলিয়াছে,
দুই দিকের দুই স্প্রিংবিহীন চাকার অবিশ্রাম ছড়্ছড়্ খড়্খড়্ শব্দটাকে
জীবনরথযাত্রার একটা বিধিবিহিত নিয়মের মধ্যেই ধরিয়া লইয়াছে।
বরঞ্চ ঘরে যেদিন কোনো শব্দমাত্র নাই, সমস্ত থম্থম্ ছম্ছম্ করিতেছে,
সেদিন একটা আসন্ন অনৈসর্গিক উপদ্রবের আশঙ্কা জন্মিত, সেদিন যে কখন কী হইবে তাহা কেহ হিসাব করিয়া বলিতে পারিত না।
আমাদের গল্পের ঘটনা যেদিন আরম্ভ হইল সেদিন
সন্ধ্যার প্রাক্কালে দুই ভাই যখন জন খাটিয়া শ্রান্তদেহে ঘরে ফিরিয়া আসিল তখন দেখিল
স্তব্ধ গৃহ গম্গম্ করিতেছে।
বাহিরেও অত্যন্ত গুমট। দুই-প্রহরের সময় খুব
এক-পসলা বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে। এখনও চারিদিকে মেঘ জমিয়া আছে। বাতাসের লেশমাত্র নাই।
বর্ষায় ঘরের চারিদিকে জঙ্গল এবং আগাছাগুলা অত্যন্ত বাড়িয়া উঠিয়াছে, সেখান হইতে এবং জলমগ্ন পাটের
খেত হইতে সিক্ত উদ্ভিজ্জের ঘন গন্ধবাষ্প চতুর্দিকে একটি নিশ্চল প্রাচীরের মতো জমাট
হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। গোয়ালের পশ্চাদ্ বর্তী ডোবার মধ্য হইতে ভেক ডাকিতেছে এবং
ঝিল্লিরবে সন্ধ্যার নিস্তব্ধ আকাশ একেবারে পরিপূর্ণ।
অদূরে বর্ষার পদ্মা নবমেঘচ্ছায়ায় বড়ো স্থির
ভয়ংকর ভাব ধারণ করিয়া চলিয়াছে। শস্যক্ষেত্রের অধিকাংশই ভাঙিয়া লোকালয়ের কাছাকাছি
আসিয়া পড়িয়াছে। এমন-কি, ভাঙনের ধারে দুই-চারিটা আম-কাঁঠাল গাছের শিকড় বাহির হইয়া দেখা দিয়াছে,
যেন তাহাদের নিরুপায় মুষ্টির প্রসারিত অঙ্গুলিগুলি শূন্যে একটা-কিছু
অন্তিম অবলম্বন আঁকড়াইয়া ধরিবার চেষ্টা করিতেছে।
দুখিরাম এবং ছিদাম সেদিন জমিদারের কাছারি-ঘরে
কাজ করিতে গিয়াছিল। ও পারের চরে জলিধান পাকিয়াছে। বর্ষায় চর ভাসিয়া যাইবার পূর্বেই
ধান কাটিয়া লইবার জন্য দেশের দরিদ্র লোক মাত্রেই কেহ বা নিজের খেতে কেহ বা পাট
খাটিতে নিযুক্ত হইয়াছে; কেবল কাছারি হইতে পেয়াদা আসিয়া এই দুই ভাইকে জবরদস্তি করিয়া ধরিয়া লইয়া
গেল। কাছারি-ঘরে চাল ভেদ করিয়া স্থানে স্থানে জল পড়িতেছিল তাহাই সারিয়া দিতে এবং
গোটাকতক ঝাঁপ নির্মাণ করিতে তাহারা সমস্তদিন খাটিয়াছে। বাড়ি আসিতে পায় নাই,
কাছারি হইতেই কিঞ্চিৎ জলপান খাইয়াছে। মধ্যে মধ্যে বৃষ্টিতেও ভিজিতে
হইয়াছে— উচিতমত পাওনা মজুরি পায় নাই, এবং
তাহার পরিবর্তে যে-সকল অন্যায় কটু কথা শুনিতে হইয়াছে, সে
তাহাদের পাওনার অনেক অতিরিক্ত।
পথের কাদা এবং জল ভাঙিয়া সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া দুই ভাই
দেখিল, ছোটো জা চন্দরা ভূমিতে অঞ্চল পাতিয়া চুপ করিয়া পড়িয়া আছে— আজিকার এই মেঘলা দিনের মতো সেও মধ্যাহ্নে প্রচুর অশ্রু-বর্ষণপূর্বক
সায়াহ্নের কাছাকাছি ক্ষান্ত দিয়া অত্যন্ত গুমট করিয়া আছে; আর
বড়ো জা রাধা মুখটা মস্ত করিয়া দাওয়ায় বসিয়া ছিল- তাহার দেড় বৎসরের ছোটো ছেলেটি
কাঁদিতেছিল, দুই ভাই যখন প্রবেশ করিল, দেখিল
উলঙ্গ শিশু প্রাঙ্গণের এক পার্শ্বে চিৎ হইয়া পড়িয়া ঘুমাইয়া আছে।
ক্ষুধিত
দুখিরাম আর কালবিলম্ব না করিয়া বলিল, “ভাত দে।”
বড়ো
বউ বারুদের বস্তায় স্ফুলিঙ্গপাতের মতো একমুহূর্তেই তীব্র কণ্ঠস্বর আকাশ-পরিমাণ
করিয়া বলিয়া উঠিল, “ভাত কোথায় যে ভাত দিব। তুই কি চাল দিয়া গিয়াছিলি।
আমি কি নিজে রোজগার করিয়া আনিব।”
সারাদিনের
শ্রান্তি ও লাঞ্ছনার পর অন্নহীন নিরানন্দ অন্ধকার ঘরে প্রজ্বলিত ক্ষুধানলে, গৃহিণীর
রুক্ষ বচন, বিশেষত শেষ কথাটার গোপন কুৎসিত শ্লেষ দুখিরামের
হঠাৎ কেমন একেবারেই অসহ্য হইয়া উঠিল। ক্রুদ্ধ ব্যাঘ্রের ন্যায় গম্ভীর গর্জনে বলিয়া
উঠিল, “কী বললি!” বলিয়া মুহূর্তের
মধ্যে দা লইয়া কিছু না ভাবিয়া একেবারে স্ত্রীর মাথায় বসাইয়া দিল। রাধা তাহার ছোটো
জায়ের কোলের কাছে পড়িয়া গেল এবং মৃত্যু হইতে মুহূর্ত বিলম্ব হইল না।
চন্দরা
রক্তসিক্ত বস্ত্রে “কী হল গো” বলিয়া চীৎকার করিয়া
উঠিল। ছিদাম তাহার মুখ চাপিয়া ধরিল। দুখিরাম দা ফেলিয়া মুখে হাত দিয়া হতবুদ্ধির
মতো ভূমিতে বসিয়া পড়িল। ছেলেটা জাগিয়া উঠিয়া ভয়ে চীৎকার করিয়া কাঁদিতে লাগিল।
বাহিরে তখন পরিপূর্ণ শান্তি। রাখালবালক গোরু লইয়া গ্রামে ফিরিয়া
আসিতেছে। পরপারের চরে যাহারা নূতনপক্ক ধান কাটিতে গিয়াছিল তাহারা পাঁচ-সাতজনে
এক-একটি ছোটো নৌকায় এ পারে ফিরিয়া পরিশ্রমের পুরস্কার দুই-চারি আঁটি ধান মাথায়
লইয়া প্রায় সকলেই নিজ নিজ ঘরে আসিয়া পৌঁছিয়াছে।
চক্রবর্তীদের
বাড়ির রামলোচন খুড়ো গ্রামের ডাকঘরে চিঠি দিয়া ঘরে ফিরিয়া নিশ্চিন্তমনে চুপচাপ
তামাক খাইতেছিলেন। হঠাৎ মনে পড়িল, তাঁহার কোর্ফা প্রজা দুখির অনেক টাকা
খাজনা বাকি; আজ কিয়দংশ শোধ করিবে প্রতিশ্রুত হইয়াছিল।
এতক্ষণে তাহারা বাড়ি ফিরিয়াছে স্থির করিয়া, চাদরটা কাঁধে
ফেলিয়া, ছাতা লইয়া বাহির হইলেন।
কুরিদের
বাড়িতে ঢুকিয়া তাঁহার গা ছম্ ছম্ করিয়া উঠিল। দেখিলেন, ঘরে
প্রদীপ জ্বালা হয় নাই। অন্ধকার দাওয়ায় দুই-চারিটা অন্ধকার মূর্তি অস্পষ্ট দেখা
যাইতেছে। রহিয়া রহিয়া দাওয়ার এক কোণ হইতে একটা অস্ফুট রোদন উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতেছে—
এবং ছেলেটা যত ‘মা মা’ বলিয়া
কাঁদিয়া উঠিতে চেষ্টা করিতেছে ছিদাম তাহার মুখ চাপিয়া ধরিতেছে।
রামলোচন
কিছু ভীত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “দুখি, আছিস নাকি।”
দুখি
এতক্ষণ প্রস্তরমূর্তির মতো নিশ্চল হইয়া বসিয়া ছিল, তাহার নাম ধরিয়া
ডাকিবামাত্র একেবারে অবোধ বালকের মতো উচ্ছ্বসিত হইয়া কাঁদিয়া উঠিল।
ছিদাম
তাড়াতাড়ি দাওয়া হইতে অঙ্গনে নামিয়া চক্রবর্তীর নিকটে আসিল। চক্রবর্তী জিজ্ঞাসা
করিলেন,
“মাগীরা বুঝি ঝগড়া করিয়া বসিয়া আছে? আজ তো
সমস্ত দিনই চীৎকার শুনিয়াছি।”
এতক্ষণ
ছিদাম কিংকর্তব্য কিছুই ভাবিয়া উঠিতে পারে নাই। নানা অসম্ভব গল্প তাহার মাথায়
উঠিতেছিল। আপাতত স্থির করিয়াছিল, রাত্রি কিঞ্চিৎ অধিক হইলে মৃতদেহ কোথাও
সরাইয়া ফেলিবে। ইতিমধ্যে যে চক্রবর্তী আসিয়া উপস্থিত হইবে, এ
সে মনেও করে নাই। ফস্ করিয়া কোনো উত্তর জোগাইল না। বলিয়া ফেলিল, “হাঁ, আজ খুব ঝগড়া হইয়া গিয়াছে।”
চক্রবর্তী
দাওয়ার দিকে অগ্রসর হইবার উপক্রম করিয়া বলিল, “কিন্তু সে জন্য দুখি কাঁদে
কেন রে।”
ছিদাম দেখিল, আর রক্ষা হয় না; হঠাৎ বলিয়া ফেলিল, “ঝগড়া করিয়া ছোটোবউ বড়ো বউয়ের
মাথায় এক দায়ের কোপ বসাইয়া দিয়াছে।”
উপস্থিত বিপদ ছাড়া যে আর-কোনো বিপদ থাকিতে পারে, এ কথা সহজে মনে হয় না। ছিদাম
তখন ভাবিতেছিল, ‘ভীষণ সত্যের হাত হইতে কী করিয়া রক্ষা পাইব।’
মিথ্যা যে তদপেক্ষা ভীষণ হইতে পারে তাহা তাহার জ্ঞান হইল না।
রামলোচনের প্রশ্ন শুনিবামাত্র তাহার মাথায় তৎক্ষণাৎ একটা উত্তর জোগাইল এবং
তৎক্ষণাৎ বলিয়া ফেলিল।
রামলোচন চমকিয়া উঠিয়া কহিল, “অ্যাঁ! বলিস কী! মরে নাই তো! ”
ছিদাম কহিল, “মরিয়াছে।” বলিয়া
চক্রবর্তীর পা জড়াইয়া ধরিল।
চক্রবর্তী পালাইবার পথ পায় না। ভাবিল, ‘রাম রাম! সন্ধ্যাবেলায় এ কী
বিপদেই পড়িলাম। আদালতে সাক্ষ্য দিতে দিতেই প্রাণ বাহির হইয়া পড়িবে!’ ছিদাম কিছুতেই তাঁহার পা ছাড়িল না; কহিল, “দাদাঠাকুর, এখন আমার বউকে বাঁচাইবার কী উপায় করি।”
মামলা-মোকদ্দমার পরামর্শে রামলোচন সমস্ত
গ্রামের প্রধান মন্ত্রী ছিলেন। তিনি একটু ভাবিয়া বলিলেন, “দেখ্ ইহার এক উপায় আছে। তুই
এখনই থানায় ছুটিয়া যা— বল্ গে, তোর
বড়ো ভাই দুখি সন্ধ্যাবেলায় ঘরে আসিয়া ভাত চাহিয়াছিল, ভাত
প্রস্তুত ছিল না বলিয়া স্ত্রীর মাথায় দা বসাইয়া দিয়াছে। আমি নিশ্চয় বলিতেছি,
এ কথা বলিলে ছুঁড়িটা বাঁচিয়া যাইবে।”
ছিদামের কণ্ঠ শুষ্ক হইয়া আসিল; উঠিয়া কহিল, “ঠাকুর, বউ গেলে বউ পাইব, কিন্তু
আমার ভাই ফাঁসি গেলে আর তো ভাই পাইব না।” কিন্তু, যখন নিজের স্ত্রীর নামে দোষারোপ করিয়াছিল তখন এ-সকল কথা ভাবে নাই।
তাড়াতাড়িতে একটা কাজ করিয়া ফেলিয়াছে, এখন অলক্ষিতভাবে মন
আপনার পক্ষে যুক্তি এবং প্রবোধ সঞ্চয় করিতেছে।
চক্রবর্তীও কথাটা যুক্তিসংগত বোধ করিলেন; কহিলেন, “তবে যেমনটি ঘটিয়াছে তাই বলিস, সকল দিক রক্ষা করা
অসম্ভব।”
বলিয়া রামলোচন অবিলম্বে প্রস্থান করিল এবং
দেখিতে দেখিতে গ্রামে রাষ্ট্র হইল যে, কুরিদের বাড়ির চন্দরা রাগারাগি করিয়া তাহার
বড়ো জায়ের মাথায় দা বসাইয়া দিয়াছে।
বাঁধ ভাঙিলে যেমন জল আসে গ্রামের মধ্যে তেমনি
হুহুঃ শব্দে পুলিস আসিয়া পড়িল; অপরাধী এবং নিরপরাধী সকলেই বিষম উদ্ বিগ্ন হইয়া উঠিল।
দ্বিতীয়
পরিচ্ছেদ
ছিদাম ভাবিল, যে পথ কাটিয়া ফেলিয়াছে সেই
পথেই চলিতে হইবে। সে চক্রবর্তীর কাছে নিজমুখে এক কথা বলিয়া ফেলিয়াছে, সে কথা গাঁ-সুদ্ধ রাষ্ট্র হইয়া পড়িয়াছে; এখন আবার
আর-একটা কিছু প্রকাশ হইয়া পড়িলে কী জানি কী হইতে কী হইয়া পড়িবে সে নিজেই কিছু
ভাবিয়া পাইল না। মনে করিল, কোনোমতে সে কথাটা রক্ষা করিয়া
তাহার সহিত আর পাঁচটা গল্প জুড়িয়া স্ত্রীকে রক্ষা করা ছাড়া আর কোনো পথ নাই।
ছিদাম তাহার স্ত্রী চন্দরাকে অপরাধ নিজ স্কন্ধে
লইবার জন্য অনুরোধ করিল। সে তো একেবারে বজ্রাহত হইয়া গেল। ছিদাম তাহাকে আশ্বাস
দিয়া কহিল, “যাহা
বলিতেছি তাই কর্, তোর কোনো ভয় নাই, আমরা
তোকে বাঁচাইয়া দিব”- আশ্বাস দিল বটে কিন্তু গলা শুকাইল,
মুখ পাংশুবর্ণ হইয়া গেল।
চন্দরার বয়স সতেরো-আঠারোর অধিক হইবে না।
মুখখানি হৃষ্টপুষ্ট গোলগাল; শরীরটি অনতিদীর্ঘ; আঁটসাঁট; সুস্থসবল,
অঙ্গপ্রত্যঙ্গের
মধ্যে এমন একটি সৌষ্ঠব আছে যে চলিতে ফিরিতে নড়িতে চড়িতে দেহের কোথাও যেন কিছু বাধে
না। একখানি নূতন-তৈরি নৌকার মতো; বেশ ছোটো এবং সুডোল, অত্যন্ত সহজে সরে এবং তাহার কোথাও কোনো গ্রন্থি শিথিল হইয়া যায় নাই।
পৃথিবীর সকল বিষয়েই তাহার একটা কৌতুক এবং কৌতূহল আছে; পাড়ায়
গল্প করিতে যাইতে ভালোবাসে; এবং কুম্ভ কক্ষে ঘাটে
যাইতে-আসিতে দুই অঙ্গুলি দিয়া ঘোমটা ঈষৎ ফাঁক করিয়া উজ্জ্বল চঞ্চল ঘনকৃষ্ণ চোখ
দুটি দিয়া পথের মধ্যে দর্শনযোগ্য যাহা-কিছু সমস্ত দেখিয়া লয়।
বড়োবউ ছিল ঠিক ইহার উলটা; অত্যন্ত এলোমেলো ঢিলেঢালা,
অগোছালো। মাথার কাপড়, কোলের শিশু, ঘরকন্নার কাজ কিছুই সে সামলাইতে পারিত না। হাতে বিশেষ একটা কিছু কাজও নাই
অথচ কোনো কালে যেন সে অবসর করিয়া উঠিতে পারে না। ছোটো জা তাহাকে অধিক কিছু কথা
বলিত না, মৃদুস্বরে দুই-একটা তীক্ষ্ম দংশন করিত, আর সে হাউ-হাউ দাউ-দাউ করিয়া রাগিয়া-মাগিয়া বকিয়া-ঝকিয়া সারা হইত এবং
পাড়াসুদ্ধ অস্থির করিয়া তুলিত।
এই দুই জুড়ি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও স্বভাবের
একটা আশ্চর্য ঐক্য ছিল। দুখিরাম মানুষটা কিছু বৃহদায়তনের— হাড়গুলা খুব চওড়া, নাসিকা খর্ব, দুটি চক্ষু এই দৃশ্যমান সংসারকে যেন
ভালো করিয়া বোঝে না, অথচ ইহাকে কোনোরূপ প্রশ্ন করিতেও চায়
না। এমন নিরীহ অথচ ভীষণ, এমন সবল অথচ নিরুপায় মানুষ অতি
দুর্লভ।
আর ছিদামকে একখানি চক্চকে কালো পাথরে কে যেন
বহুযত্নে কুঁদিয়া গড়িয়া তুলিয়াছে। লেশমাত্র বাহুল্য-বর্জিত এবং কোথাও যেন কিছু টোল
খায় নাই। প্রত্যেক অঙ্গটি বলের সহিত নৈপুণ্যের সহিত মিশিয়া অত্যন্ত সম্পূর্ণতা লাভ
করিয়াছে। নদীর উচ্চপাড় হইতে লাফাইয়া পড়ুক, লগি দিয়া নৌকা ঠেলুক, বাঁশগাছে চড়িয়া বাছিয়া বাছিয়া কঞ্চি কাটিয়া আনুক, সকল
কাজেই তাহার একটি পরিমিত পারিপাট্য, একটি অবলীলাকৃত শোভা প্রকাশ
পায়। বড়ো বড়ো কালো চুল তেল দিয়া কপাল হইতে যত্নে আঁচড়াইয়া তুলিয়া কাঁধে আনিয়া
ফেলিয়াছে— বেশভূষা সাজসজ্জায় বিলক্ষণ একটু যত্ন আছে।
অপরাপর গ্রামবধূদিগের সৌন্দর্যের প্রতি যদিও
তাহার উদাসীন দৃষ্টি ছিল না, এবং তাহাদের চক্ষে আপনাকে মনোরম করিয়া তুলিবার ইচ্ছাও তাহার
যথেষ্ট ছিল— তবু ছিদাম তাহার যুবতী স্ত্রীকে একটু বিশেষ
ভালোবাসিত। উভয়ে ঝগড়াও হইত, ভাবও হইত, কেহ
কাহাকেও পরাস্ত করিতে পারিত না। আর-একটি কারণে উভয়ের মধ্যে বন্ধন কিছু সুদৃঢ় ছিল।
ছিদাম মনে করিত, চন্দরা যেরূপ চটুল চঞ্চল প্রকৃতির স্ত্রীলোক,
তাহাকে যথেষ্ট বিশ্বাস নাই; আর চন্দরা মনে
করিত, আমার স্বামীটির চতুর্দিকেই দৃষ্টি, তাহাকে কিছু কষাকষি করিয়া না বাঁধিলে কোন্দিন হাতছাড়া হইতে আটক নাই।
উপস্থিত ঘটনা ঘটিবার কিছুকাল পূর্বে হইতে
স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে ভারি একটা গোলযোগ চলিতেছিল। চন্দরা দেখিয়াছিল, তাহার স্বামী কাজের ওজর করিয়া
মাঝে মাঝে দূরে চলিয়া যায়, এমন-কি দুই-একদিন অতীত করিয়া আসে,
অথচ কিছু উপার্জন করিয়া আনে না। লক্ষণ মন্দ দেখিয়া সে ও কিছু বাড়াবাড়ি
দেখাইতে লাগিল। যখন-তখন ঘাটে যাইতে আরম্ভ করিল এবং পাড়া পর্যটন করিয়া আসিয়া কাশী
মজুমদারের মেজো ছেলেটির প্রচুর ব্যাখ্যা করিতে লাগিল।
ছিদামের দিন এবং রাত্রিগুলির মধ্যে কে যেন বিষ
মিশাইয়া দিল। কাজে-কর্মে কোথাও একদণ্ড গিয়া সুস্থির হইতে পারে না। একদিন ভাজকে
আসিয়া ভারি ভর্ৎসনা করিল। সে হাত নাড়িয়া ঝংকার দিয়া অনুপস্থিত মৃত পিতাকে সম্বোধন
করিয়া বলিল, “ও মেয়ে ঝড়ের আগে ছোটে, উহাকে আমি সামলাইব! আমি জানি,
ও কোন্দিন কী সর্বনাশ করিয়া বসিবে।”
চন্দরা পাশের ঘর হইতে আসিয়া আস্তে আস্তে কহিল, “কেন দিদি, তোমার এত ভয় কিসের।” এই— দুই
জায়ে বিষম দ্বন্দ্ব বাধিয়া গেল।
ছিদাম চোখ পাকাইয়া বলিল, “এবার যদি কখনো শুনি তুই একলা
ঘাটে গিয়াছিস, তোর হাড় গুঁড়াইয়া দিব।”
চন্দরা বলিল, “তাহা হইলে তো হাড় জুড়ায়।”
বলিয়া তৎক্ষণাৎ বাহিরে যাইবার উপক্রম করিল।
ছিদাম এক লম্ফে তাহার চুল ধরিয়া টানিয়া ঘরে পুরিয়া
বাহির হইতে দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিল।
কর্মস্থান হইতে সন্ধ্যাবেলায় ফিরিয়া আসিয়া দেখে
ঘর খোলা, ঘরে কেহ
নাই। চন্দরা তিনটে গ্রাম ছাড়াইয়া একেবারে তাহার মামার বাড়ি গিয়া উপস্থিত হইয়াছে।
ছিদাম সেখান হইতে বহুকষ্টে অনেক সাধ্যসাধনায়
তাহাকে ঘরে ফিরাইয়া আনিল, কিন্তু এবার পরাস্ত মানিল। দেখিল, এক অঞ্জলি পারদকে
মুষ্টির মধ্যে শক্ত করিয়া ধরা যেমন দুঃসাধ্য এই মুষ্টিমেয় স্ত্রীটুকুকেও কঠিন
করিয়া ধরিয়া রাখা তেমনি অসম্ভব— ও যেন দশ আঙুলের ফাঁক দিয়া
বাহির হইয়া পড়ে।
আর কোনো জবর্দস্তি করিল না, কিন্তু বড়ো অশান্তিতে বাস
করিতে লাগিল। তাহার এই চঞ্চলা যুবতী স্ত্রীর প্রতি সদাশঙ্কিত ভালোবাসা উগ্র একটা
বেদনার মতো বিষম টনটনে হইয়া উঠিল। এমন-কি, এক-একবার মনে হইত,
এ যদি মরিয়া যায় তবে আমি নিশ্চিন্ত হইয়া একটুখানি শান্তিলাভ করিতে
পারি। মানুষের উপরে মানুষের যতটা ঈর্ষা হয় যমের উপরে এতটা নহে।
এমন সময় ঘরে সেই বিপদ ঘটিল।
চন্দরাকে যখন তাহার স্বামী খুন স্বীকার করিয়া
লইতে কহিল সে স্তম্ভিত হইয়া চাহিয়া রহিল; তাহার কালো দুটি চক্ষু কালো অগ্নির ন্যায়
নীরবে তাহার স্বামীকে দগ্ধ করিতে লাগিল। তাহার সমস্ত শরীর মন যেন ক্রমেই সংকুচিত
হইয়া স্বামীরাক্ষসের হাত হইতে বাহির হইয়া আসিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। তাহার সমস্ত
অন্তরাত্মা একান্ত বিমুখ হইয়া দাঁড়াইল।
ছিদাম আশ্বাস দিল, “তোমার কিছু ভয় নাই।” বলিয়া পুলিসের কাছে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে কী বলিতে হইবে বারবার শিখাইয়া
দিল। চন্দরা সে সমস্ত দীর্ঘ কাহিনী কিছুই শুনিল না, কাঠের
মূর্তি হইয়া বসিয়া রহিল।
সমস্ত কাজেই ছিদামের উপর দুখিরামের একমাত্র
নির্ভর। ছিদাম যখন চন্দরার উপর দোষারোপ করিতে বলিল, দুখি বলিল, “তাহা হইলে বউমার কী হইবে।”
ছিদাম কহিল, “উহাকে আমি বাঁচাইয়া দিব।” বৃহৎকায় দুখিরাম নিশ্চিন্ত হইল।
তৃতীয়
পরিচ্ছেদ
ছিদাম তাহার স্ত্রীকে শিখাইয়া দিয়াছিল যে, তুই বলিস, বড়ো জা আমাকে বঁটি লইয়া মারিতে আসিয়াছিল, আমি তাহাকে
দা লইয়া ঠেকাইতে গিয়া হঠাৎ কেমন করিয়া লাগিয়া গিয়াছে। এ-সমস্তই রামলোচনের রচিত।
ইহার অনুকূলে যে যে অলংকার এবং প্রমাণ-প্রয়োগের আবশ্যক তাহাও সে বিস্তারিতভাবে
ছিদামকে শিখাইয়াছিল।
পুলিস আসিয়া তদন্ত করিতে লাগিল। চন্দরাই যে
তাহার বড়ো জাকে খুন করিয়াছে গ্রামের সকল লোকের মনে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল হইয়া
গিয়াছে। সকল সাক্ষীর দ্বারাই সেইরূপ প্রমাণ হইল। পুলিস যখন চন্দরাকে প্রশ্ন করিল
চন্দরা কহিল, “হাঁ, আমি খুন করিয়াছি।”
কেন খুন করিয়াছ।
আমি তাহাকে দেখিতে পারিতাম না।
কোনো বচসা হইয়াছিল?
না।
সে তোমাকে প্রথমে মারিতে আসিয়াছিল?
না।
তোমার
প্রতি কোনো অত্যাচার করিয়াছিল?
না।
এইরূপ
উত্তর শুনিয়া সকলে অবাক হইয়া গেল।
ছিদাম
তো একেবারে অস্থির হইয়া উঠিল। কহিল, “উনি ঠিক কথা বলিতেছেন না।
বড়োবউ প্রথমে—”
দারোগা
খুব এক তাড়া দিয়া তাহাকে থামাইয়া দিল। অবশেষে তাহাকে বিধিমতে জেরা করিয়া বার বার
সেই একই উত্তর পাইল— বড়োবউয়ের দিক হইতে কোনোরূপ আক্রমণ চন্দরা কিছুতেই
স্বীকার করিল না।
এমন
একগুঁয়ে মেয়েও তো দেখা যায় না। একেবারে প্রাণপণে ফাঁসিকাষ্ঠের দিকে ঝুঁকিয়াছে, কিছুতেই
তাহাকে টানিয়া রাখা যায় না। এ কী নিদারুণ অভিমান। চন্দরা মনে মনে স্বামীকে বলিতেছে,
আমি তোমাকে ছাড়িয়া আমার এই নবযৌবন লইয়া ফাঁসিকাঠকে বরণ করিলাম—
আমার ইহজন্মের শেষবন্ধন তাহার সহিত।
বন্দিনী
হইয়া চন্দরা, একটি নিরীহ ক্ষুদ্র চঞ্চল কৌতুকপ্রিয় গ্রামবধূ,
চির-পরিচিত গ্রামের পথ দিয়া, রথতলা দিয়া,
হাটের মধ্য দিয়া, ঘাটের প্রান্ত দিয়া, মজুমদারদের বাড়ির সম্মুখ দিয়া, পোস্টাপিস এবং
ইস্কুল-ঘরের পার্শ্ব দিয়া, সমস্ত পরিচিত লোকের চক্ষের উপর
দিয়া, কলঙ্কের ছাপ লইয়া চিরকালের মতো গৃহ ছাড়িয়া চলিয়া গেল।
এক-পাল ছেলে পিছন পিছন চলিল এবং গ্রামের মেয়েরা, তাহার
সই-সাঙাতরা কেহ ঘোমটার ফাঁক দিয়া, কেহ দ্বারের প্রান্ত হইতে,
কেহ-বা গাছের আড়ালে দাঁড়াইয়া পুলিস-চালিত চন্দরাকে দেখিয়া লজ্জায়
ঘৃণায় ভয়ে কণ্টকিত হইয়া উঠিল।
ডেপুটি
ম্যাজিস্ট্রেটের কাছেও চন্দরা দোষ স্বীকার করিল। এবং খুনের সময় বড়োবউ যে তাহার প্রতি
কোনোরূপ অত্যাচার করিয়াছিল তাহা প্রকাশ হইল না।
কিন্তু, সেদিন
ছিদাম সাক্ষ্যস্থলে আসিয়াই একেবারে কাঁদিয়া জোড়হস্তে কহিল, “দোহাই
হুজুর, আমার স্ত্রীর কোনো দোষ নাই।” হাকিম
ধমক দিয়া তাহার উচ্ছ্বাস নিবারণ করিয়া তাহাকে প্রশ্ন করিতে লাগিলেন, সে একে একে সত্য ঘটনা প্রকাশ করিল।
হাকিম
তাহার কথা বিশ্বাস করিলেন না। কারণ প্রধান বিশ্বস্ত ভদ্রসাক্ষী রামলোচন কহিল, “খুনের
অনতিবিলম্বেই আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইয়াছিলাম। সাক্ষী ছিদাম আমার নিকট সমস্ত
স্বীকার করিয়া আমার পা জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, ‘বউকে কী করিয়া
উদ্ধার করিব আমাকে যুক্তি দিন।’ আমি ভালো মন্দ কিছুই বলিলাম
না। সাক্ষী আমাকে বলিল, ‘আমি যদি বলি আমার বড়ো ভাই ভাত
চাহিয়া ভাত পায় নাই বলিয়া রাগের মাথায় স্ত্রীকে মারিয়াছে, তাহা
হইলে সে কি রক্ষা পাইবে।’ আমি কহিলাম, ‘খবরদার হারামজাদা, আদালতে এক-বর্ণও মিথ্যা বলিস না—
এতবড়ো মহাপাপ আর নাই!’ ” ইত্যাদি।
রামলোচন
প্রথমে চন্দরাকে রক্ষা করিবার উদ্দেশ্যে অনেকগুলা গল্প বানাইয়া তুলিয়াছিল, কিন্তু
যখন দেখিল চন্দরা নিজে বাঁকিয়া দাঁড়াইয়াছে তখন ভাবিল, ‘ওরে
বাপ রে শেষকালে কি মিথ্যা সাক্ষ্যের দায়ে পড়িব। যেটুকু জানি সেইটুকু বলা ভালো।’
এই মনে করিয়া রামলোচন যাহা জানে তাহাই বলিল। বরঞ্চ তাহার চেয়েও কিছু
বেশি বলিতে ছাড়িল না।
ডেপুটি
ম্যাজিস্ট্রেট সেশনে চালান দিলেন।
ইতিমধ্যে
চাষবাস হাটবাজার হাসিকান্না পৃথিবীর সমস্ত কাজ চলিতে লাগিল। এবং পূর্ব পূর্ব
বৎসরের মতো নবীন ধান্যক্ষেত্রে শ্রাবণের অবিরল বৃষ্টিধারা বর্ষিত হইতে লাগিল।
পুলিস
আসামী এবং সাক্ষী লইয়া আদালতে হাজির। সম্মুখবর্তী মুন্সেফের কোর্টে বিস্তর লোক নিজ
নিজ মোকদ্দমার অপেক্ষায়
বসিয়া আছে।
রন্ধনশালার পশ্চাদ্ বর্তী একটি ডোবার অংশবিভাগ লইয়া কলিকাতা হইতে এক উকিল আসিয়াছে
এবং তদুপলক্ষে বাদীর পক্ষে উনচল্লিশজন সাক্ষী উপস্থিত আছে। কতশত লোক আপন আপন
কড়াগণ্ডা হিসাবের চুলচেরা মীমাংসা করিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া আসিয়াছে, জগতে আপাতত
তদপেক্ষা গুরুতর আর-কিছুই উপস্থিত নাই এইরূপ তাহাদের ধারণা। ছিদাম বাতায়ন হইতে এই
অত্যন্ত ব্যস্তসমস্ত প্রতিদিনের পৃথিবীর দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া আছে, সমস্তই স্বপ্নের মতো বোধ হইতেছে। কম্পাউণ্ডের বৃহৎ বটগাছ হইতে একটি কোকিল
ডাকিতেছে—তাহাদের কোনোরূপ আইন-আদালত নাই।
চন্দরা জজের কাছে কহিল, “ওগো সাহেব, এক কথা আর বারবার কতবার করিয়া বলিব।”
জজসাহেব তাহাকে বুঝাইয়া বলিলেন, “তুমি যে অপরাধ স্বীকার করিতেছ
তাহার শাস্তি কী জান? ”
চন্দরা কহিল, “না।”
জজসাহেব কহিলেন, “তাহার শাস্তি ফাঁসি।”
চন্দরা কহিল, “ওগো, তোমার
পায়ে পড়ি তাই দা-ওনা সাহেব। তোমাদের যাহা খুশি করো, আমার তো
আর সহ্য হয় না।”
যখন ছিদামকে আদালতে উপস্থিত করিল চন্দরা মুখ
ফিরাইল। জজ কহিলেন, “সাক্ষীর দিকে চাহিয়া বলো এ তোমার কে হয়।”
চন্দরা দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া কহিল, “ও আমার স্বামী হয়।”
প্রশ্ন হইল, ও তোমাকে ভালোবাসে না?
উত্তর। উঃ, ভারি ভালোবাসে।
প্রশ্ন। তুমি উহাকে ভালোবাস না?
উত্তর। খুব ভালোবাসি।
ছিদামকে যখন প্রশ্ন হইল ছিদাম কহিল, “আমি খুন করিয়াছি।”
প্রশ্ন। কেন।
ছিদাম। ভাত চাহিয়াছিলাম, বড়োবউ ভাত দেয় নাই।
দুখিরাম সাক্ষ্য দিতে আসিয়া মূর্ছিত হইয়া পড়িল।
মূর্ছাভঙ্গের পর উত্তর করিল, “সাহেব, খুন আমি করিয়াছি।”
“কেন।”
“ভাত চাহিয়াছিলাম, ভাত দেয় নাই।”
বিস্তর জেরা করিয়া এবং অন্যান্য সাক্ষ্য শুনিয়া
জজসাহেব স্পষ্ট বুঝিতে পারিলেন, ঘরের স্ত্রীলোককে ফাঁসির অপমান হইতে বাঁচাইবার জন্য ইহারা দুই
ভাই অপরাধ স্বীকার করিতেছে। কিন্তু, চন্দরা পুলিস হইতে সেশন
আদালত পর্যন্ত বরাবর এককথা বলিয়া আসিতেছে, তাহার কথার
তিলমাত্র নড়চড় হয় নাই। দুইজন উকিল স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত হইয়া তাহাকে প্রাণদণ্ড হইতে
রক্ষা করিবার জন্য বিস্তর চেষ্টা করিয়াছে, কিন্তু অবশেষে
তাহার নিকট পরাস্ত মানিয়াছে।
যেদিন একরত্তি বয়সে একটি কালোকোলো ছোটোখাটো
মেয়ে তাহার গোলগাল মুখটি লইয়া খেলার পুতুল ফেলিয়া বাপের ঘর হইতে শ্বশুরঘরে আসিল
সেদিন রাত্রে শুভলগ্নের সময় আজিকার দিনের কথা কে কল্পনা করিতে পারিত। তাহার বাপ
মরিবার সময় এই বলিয়া নিশ্চিন্ত হইয়াছিল যে, ‘যাহা হউক, আমার
মেয়েটির একটি সদগতি করিয়া গেলাম।’
জেলখানায় ফাঁসির পূর্বে দয়ালু সিভিল সার্জন
চন্দরাকে জিজ্ঞাসা করিল, “কাহাকেও দেখিতে ইচ্ছা কর?”
চন্দরা কহিল, “একবার আমার মাকে দেখিতে চাই।”
ডাক্তার কহিল “তোমার স্বামী তোমাকে দেখিতে চায়, তাহাকে কি ডাকিয়া আনিব।”
চন্দরা
কহিল, “মরণ!—”
No comments:
Post a Comment
Please do not enter any Link in the comment box.