Rock Art / গুহা চিত্র
................
গুহাচিত্র
গুহাচিত্র (ইংরেজি Cave Painting বা "parietal
art") হল সেই সব চিত্র যা প্রাচীন গুহার দেয়াল বা ছাদে
আবিষ্কার করা হয়েছে। বিশেষ করে সেই সকল চিত্রকর্ম যা প্রাগৈতিহাসিক কালে মানুষেরা
প্রায় ৪০,০০০ হাজার বছর আগে (আনুমানিক ৩৮,০০০
খ্রীস্টপূর্বাব্দ) অঙ্কন করেছিল। এশিয়া ও ইউরোপে এই গুহা চিত্রগুলি
পাওয়া গিয়েছে। পুরাতন প্রস্তরযুগ এই সকল চিত্রকর্ম
ঠিক কি কারণে অঙ্কন করা হয়েছিল তা জানা যায়নি। সংগৃহিত প্রমাণাদি থেকে ইঙ্গিত
পাওয়া যায় যে নিছক গৃহসজ্জার জন্য এই চিত্রগুলো অঙ্কন করা হয়নি। কারণ, এই গুহাগুলি বা তার
আশেপাশে মানুষের কোন বসতি থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাছারা প্রায়ই সব গুহাই
খুব দুর্গম এলাকায় অবস্থিত। কিছু মতবাদ অনুযায়ী, গুহাচিত্র দ্বারা
প্রগৈতিহাসিক মানুষেরা একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করত। যদিও অনেকে আবার মনে করেন যে
এগুলো সম্পূর্ণ ধর্মীয় বা আনুষ্ঠানিকতার কাজে ব্যবহৃত হত। প্রায় সবগুলো চিত্রই
একই রকম যেখানে পশু হচ্ছে প্রধান উপজিব্য বিষয়। চিত্রকর্মের বিষয় হিসাবে মানুষ
এসেছে মূলতঃ তার হাতের ছাপ এর মধ্য দিয়ে।
মানুষের হাতে রঙ মেখে গুহার দেয়ালে এই হাতের ছাপগুলো তৈরী করা হয়েছিল। ২০১৪
সালের ঘোষণা অনুযায়ী, ইন্দোনেশিয়ার মারকো দ্বীপে পাওয়া
গুহাচিত্রটি এ পর্যন্ত প্রাপ্ত সবচেয়ে প্রাচীন যার বয়স আনুমানিক ৩৫,০০০ বছর। এর আগে
ধারণা করা হতো যে, সবচেয়ে প্রাচীন গুহাচিত্রটি ইউরোপে আবস্থিত। ইউরোপে প্রাপ্ত Aurignacian যুগে অঙ্কিত
অনিন্দ্য চিত্রকর্মটির বয়স আনুমানিক ৩০,০০০ থেকে ৩২,০০০ বছর। এটি পাওয়া
গিয়েছিল ফ্রান্সের Chauvet গুহায় এবং রোমানিয়ার কোলিবোয়াই গুহায়।
আবিষ্কারের
ইতিহাস
বয়স
ফ্রান্স ও স্পেনে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৪০ এর কাছাকাছি গুহা আবিষ্কৃত
হয়েছে যেগুলোতে প্রাগৈতিহাসিক কালে অঙ্কিত চিত্র পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে,
চিত্রগুলোর
বয়স নিয়ে বিতর্ক আছে, কারণ, রেডিওকার্বন ডেটিং এর মতো পদ্ধতি অনেক
সময় ভুল তথ্য প্রদান করতে পারে। বিশেষ করে যখন পুরাতন নমুনার সাথে নতুন নমুনা
মিশে যাবার সম্ভবনা থাকে, বহু বছরের জঞ্জালে গুহাগুলো ভর্তি হওয়ায় কার্বন
পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় নমুনা সংগ্রহ করা দুরূহ। কিন্তু ক্রমেই আধুনিক
প্রযুক্তির সাহায্যে গুহাচিত্রগুলোতে ব্যবহৃত রঙ ও দেয়াল ও ছাদে মশালের কালির দাগ
থেকে তাদের বয়স নির্ধারণ সম্ভব হয়েছে।এছাড়া ছবির বিষয়বস্তুও এর বয়সকাল
নির্ধারণ করে। উদাহরণ স্বরূপ, স্পেনের Cueva de las Monedas গুহায় প্রাপ্ত রেইন
ডিয়ারের ছবি আঁকা হয়েছিল সর্বশেষ বরফ যুগে।
ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপ Sulawesi তে প্রাপ্ত
গুহাচিত্রটির বয়স ৩৫,০০০ বছর। ইন্দোনেশীয় অস্ট্রেলীয় বিজ্ঞানীরা
অন্যান্য অনাড়ম্বরপূর্ণ গুহাচিত্রগুলো ৪০,০০০ বছর পুরাতন বলে
মনে করেন। বয়স নির্ধারণের পদ্ধতি হিসাবে তারা চিত্রের উপরে লবণ চুঁইয়ে তৈরী
হওয়া স্তম্ভগুলোর কার্বন ডেটিং পরীক্ষা করা হয়।
অবস্থান
দক্ষিণ আফ্রিকা
দক্ষিণ আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে প্রাপ্ত সান প্রস্তর চিত্র দক্ষিণ আফ্রিকার uKhahlamba
/ Drakensberg Park তে, প্রাপ্ত চিত্রগুলোর আনুমানিক বয়স ৩,০০০ বছর। এগুলো ছিল স্যান জাতির মানুষদের আঁকা। এই
স্যান জাতির মানুষ উক্ত অঞ্চলে ৮,০০০ বছর আগে বসবাস করত। চিত্রগুলোতে পশু ও
মানুষের ছবি দেখতে পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় সে সময়ের ধর্মীয় বিশ্বাস থেকেই এই
সব চিত্র আঁকা হয়েছিল। আফ্রিকায় পাওয়া গুহাচিত্রগুলোর বিষয়বস্তু হিসাবে
মানুষের ব্যবহার ইউরোপে পাওয়া গুহাচিত্রগুলোর চেয়ে বেশি দেখা যায়
নামিবিয়ার এ্যপোলো ১১ গুহায় প্রাপ্ত
গুহাচিত্রগুলো খ্রীস্টপূর্ব ২৩,০০০ থেকে ২৫,০০০ বছর আগে অঙ্কিত
আফ্রিকার অন্তরীপ
২০০২ সালে একদল ফরাসী প্রত্নতাত্ত্বিক সোমালিয়ার সোমালিল্যান্ড এলাকার প্রান্তে
গুহাচিত্রটি আবিষ্কার করে। প্রায় ৫,০০০ বছর পুরাতন এই গুহাচিত্রটিতে বন্যপশু
এবং সাজসজ্জা করা একটি গরুর ছবি দেখা যায়। তারা তাদের চিত্রে পশুপালনকারীদের ছবিও
অঙ্কন করেছিল। সম্ভবত তারাই এই গুহাচিত্রগুলো সৃষ্টি করেছিল।২০০৮ সালে, সোমালিয়
প্রত্নতাত্ত্বিকরা উত্তর সোমালিয়ার Dhambalin এলাকায় আর একটি
গুহাচিত্র আবিষ্কার করে। গবেষকরা ধারণা করেন যে, এটি প্রাচীন
ঘোড়সওয়ার মানুষের চিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। ১০০০ থেকে ৩০০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে
অঙ্কিত প্রস্তর চিত্রটির অঙ্কনে ইথিউপিয়ান-আরবীয় রীতি অনুসরণ করা হয়েছিল
এছাড়াও, উত্তর সোমালিয়ার Las Khorey এবং El Ayo এর মধ্যবর্তী
এলাকায় অবস্থিত Karinhegane অঞ্চলে বাস্তব ও পৌরাণিক পশুর প্রচুর চিত্রকর্ম
পাওয়া গেছে। প্রতিটি চিত্রকর্মের নিচে উৎকীর্ণ লেখা থেকে জানা
যায়, সম্মিলিতভাবে ছবিগুলো ২,৫০০ বছর পুরাতন। Karihegane এর চিত্রগুলোও Laas
Geel এবং Dhambalin
এ
প্রাপ্ত গুহাচিত্রগুলোর মতো স্বতন্ত্র ইথোপিয়ান-আরবীয় রীতি অনুসরণ করে আঁকা। Las
Khorey থেকে
প্রায় ২৫ কিমি দূরে আবিষ্কৃত Gelweita নামক স্থানে আরো অনেক প্রস্তর চিত্র
পাওয়া গেছে।
জিবুতিতে প্রাপ্ত প্রস্তর চিত্রে যে সব প্রাণীর ছবি পাওয়া
যায় তা জিরাফ এবং এন্টিলোপ বলে মনে করা হয়
উত্তর আফ্রিকা
আলজেরিয়ার Tassili n'Ajjer পর্বতমালায় অনেক
গুহাচিত্র পাওয়া গেছে। ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃত এই
এলাকার ১৫,০০০ এরও বেশি খোদাই করা প্রস্তর চিত্রগুলো ১৯৩৩ সালে প্রথম আবিষ্কৃত
হয়। এই চিত্রগুলোতে খ্রীস্টপূর্ব ৬০০০ থেকে শুরু করে প্রয়াত ধ্রুপদি যুগ পর্যন্ত সাহারার এই
অঞ্চলের দলবদ্ধ পশুর অভিবাসন, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং মানব বসতির পরিবর্তন
চিত্রিত হয়েছে।লিবিয়ার Akakus, Mesak Settafet, Tadrart এবং সাহারা অঞ্চলের Ayr
পর্বতমালা, নাইজার,
Tibesti এবং সাদে আরো কিছু গুহাচিত্র
পাওয়া গিয়েছে।
১৯৩৩ সালে হাঙ্গেরিয় অনুসন্ধানকারী László Almásy ‘সাঁতারুদের গুহা’
বা Cave
of Swimmers আবিষ্কার করে। ১০,০০০ বছরের পুরাতন অর্থাৎ পৃথিবীর সর্বশেষ বরফ যুগের এই গুহাচিত্রগুলিতে
দেখা যায় যে প্রগৈতিহাসিক মানুষ পানিতে সাঁতার কাটছে।
অস্ট্রেলিয়া
অস্ট্রেলিয়ায় প্রাপ্ত উল্লখযোগ্য গুহাচিত্রগুলো গিরিমাটির উপর অঙ্কিত। পাওয়া
গেছে Kakadu তে। গিরিমাটি জৈব পদার্থ না হওয়ার এর কার্বন
ডেটিং করে এর বয়স নির্ধারন করা সম্ভব হয়নি। এসব চিত্রের ক্ষেত্রে তাদের আঁকার
বিষয়বস্তু বা ব্যবহৃত উপকরণ থেকে তাদের বয়স আন্দাজ করা যায় মাত্র। Arnhem
Land মালভূমির
মাঝে পাওয়া গেছে লোহিত বর্ণের গিরিমাটিতে আঁকা চিত্র, যেখানে দেখা যায় ইমুর মতো দেখতে লম্বা
গলাযুক্ত পাখির ছবি। জীবাশ্মবিদদের মতে এরকম বিশালাকার
পাখিটির নাম Genyornis যেটি ৪০,০০০ বছর আগে পৃথিবী
থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে এই তথ্য ছবিগুলোর বয়স নির্ধারণের জন্য যথেষ্ট নয়।
তবে এ থেকে অন্য একটি তথ্য বিরিয়ে আসে যে পূ্র্বের ধারনার চেয়ে পাখিটি আরো অনেক
পরে বিলুপ্ত হয়েছিল। Whitsunday দ্বীপেও আশ্চর্য সংখ্যক গুহাচিত্রের হদিস
পাওয়া গেছে।
হুক দ্বীপে সমুদ্রজীবি আদিবাসী গোষ্ঠির আঁকা গুহাচিত্রর বিষয়বস্তু
তুলনামূলকভাবে বিমূর্ত বিষয়ের উপর আঁকা। এসব ছবির তাৎপর্য রহস্যই রয়ে গেছে।
ভারত
ভীমবেটকা প্রস্তরক্ষেত্র (Rock Shelters of Bhimbetaka)। ভারতের মধ্য প্রদেশ রাজ্যের রায়সেন
জেলার আবদুল্লাগঞ্জ শহরে অবস্থিত এই অঞ্চলটি ভারতের সবচেয়ে পুরনো মানব বসতির
নিদর্শন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এখানকার কিছু কিছু বসতি ১০,০০০ বছরেরও পুরান।
এখানে প্রাপ্ত সবচেয়ে পুরাতন চিত্রটি ৩০,০০০ বছর আগে মধ্য প্রস্তর যুগের আঁকা।
জ্যামিতিক নঁকশা দিয়ে কাছাকাছি সময়ে আঁকা অন্য চিত্রটি মধ্যযুগের। চিত্রগুলোতে
প্রধানত লাল ও সাদা রঙ ব্যবহার করা হয়েছে। মাঝে মাঝে সবুজ ও হলুদের ব্যবহারও দেখা
যায়। চিত্রগুলোর মূল উপজিব্য হল তৎকালীন সময়ের গুহাবাসী মানুষের জীবন যেখানে আছে মানব
শিশু জন্ম নেবার দৃশ্য, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পানাহার, নৃত্য, ধর্মীয় আচার আর
মৃতদের সৎকারের দৃশ্য। এছাড়াও
আছে দেশীয় পশুর ছবি।
উত্তর আমেরিকা
দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার San Luis Obispo কাউন্টি, সান্টা বারবারা,
ভেন্টুরায়
অবস্থিত গুহাচিত্রগুলো ছিল চুমাস উপজাতিদের আঁকা। Burro Flats এবং Chumash
Painted Cave State Historic Park এ গুহাচিত্রের চমৎকার কিছু নমুনা লক্ষ্য
করা যায়। দক্ষিণ-পশ্চিম
যুক্তরাষ্ট্রে নেটিভ আমেরিকানদের আঁকা কিছু গুহাচিত্র আছে। ৬,০০০ বছর পুরাতন গুহাচিত্র পাওয়া গছে টেনেসির Cumberland মালভূমিতে।
দক্ষিণ আমেরিকা
ব্রাজিলের উত্তর-পূর্ব এলাকায় Serra da Capivara ন্যাশনাল পার্কে
প্রাগৈতিহাসিক অনেক চিত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই ন্যাশনাল পার্কটি এ অঞ্চলে
পাওয়া প্রাচীন চিত্র ও প্রাগৈতিহাসিক আর্টিফ্যাক্ট গুলো রক্ষার জন্য নির্মাণ করা
হয়েছিল। ১৯৯১ সালে এই পার্ককে ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসাবে ঘোষণা করা
হয়। এই পার্ক Pedra Furada এর সবচেয়ে বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান।
ব্রাজিলের সবচেয়ে উত্তরের প্রদেশ Piauí এ অবস্থিত এই
পার্কের ভৌগোলিক অবস্থান হল, ৮° ২৬’ ৫০” থেকে ৮° ৫৪’ ২৩” দক্ষিণ অক্ষাংশ এবং
৪২° ১৯’ ৪৭” থেকে ৪২° ৪৫’ ৫১” পশ্চিম দ্রাঘিমার
মধ্যে অবস্থিত। এসব এলাকা São Raimundo Nonato, São João do Piauí, Coronel
José Dias এবং Canto do BuritiIt এসকল পৌরএলাকার অন্তর্গত। এর মোট আয়তন
১২৯১.৪ বর্গ কিলোমিটার (২১৯,০০০ একর)। এখানে প্রাগৈতিহাসিক ছোট ছোট
কৃষিখামারের অস্তিত্ব ছিল। বিজ্ঞানিরা নিশ্চিত করেছেন যে Capivara পর্বত প্রাগৈতিহাসিক
মানুষের ঘনবসতি ছিল।
দক্ষিণ এশিয়া
থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং
বার্মায় গুহাচিত্রের অস্তিত্ব আছে।
No comments:
Post a Comment
Please do not enter any Link in the comment box.