শিক্ষার
ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্য
শিক্ষার
লক্ষ্য এক নয়, বহু
যুগে যুগে বিভিন্ন দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য নির্ধারণ করতে
গিয়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী এবং সমাজতন্ত্রবাদী—এই দুটি গোস্টিতে বিভক্ত হয়েছেন। যেসব শিক্ষাবিদ শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে ব্যক্তির
ব্যক্তিগত বিকাশকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, তাদের বলা হয়
ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদীদের মত অনুযায়ী শিক্ষার লক্ষ্য হল
ব্যক্তির সম্ভাবনাময় ব্যক্তিত্বের যথাযথ বিকাশসাধন। শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক
লক্ষ্যের সমর্থকদের মধ্যে রয়েছেন স্যার পার্সি নান, বার্ট্রান্ড
রাসেল, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ।
শিক্ষার
ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্যের যেসব গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় সেগুলি হল—
শিক্ষার
লক্ষ্য নিরূপণের ক্ষেত্রে ব্যক্তি হল কেন্দ্রবিন্দু,
ব্যক্তিগত
পার্থক্যকে গুরুত্ব দেওয়া, ও
শিক্ষার মধ্য
দিয়ে ব্যক্তির চাহিদা পূরণ করা এবং
ব্যক্তিকে
নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে তার বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা।
শিক্ষার
ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্যের সুবিধা
ব্যক্তিতন্ত্রে
বিশ্বাসী চিন্তাবিদরা এই লক্ষ্যের কিছু সুবিধার কথা তুলে ধরেন—
মানবশিশু
পৃথিবীতে জন্মলাভ করে কতকগুলি বৈশিষ্ট্য নিয়ে। এই বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে কতকগুলি
সাধারণ এবং কতকগুলি বিশেষ প্রকৃতির হয়। কেবলমাত্র ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষাই বিশেষ
প্রকৃতির বৈশিষ্ট্যগুলিকে বিকশিত করতে এবং সংরক্ষণ করতে সমর্থ হয়।
শিশু পৃথিবীতে
আবির্ভাবের মুহূর্তে সম্পূর্ণ নিষ্কলুষ অবস্থায় থাকে। পরিবেশই তাকে কলুষিত করে।
তাই সমাজপরিবেশের বাইরে তাকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিক্ষিত করলে সে উন্নত
ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে পারে।
প্রতিটি
ব্যক্তিই একক সত্তা| দলগত পদ্ধতিতে সকলকে একসাথে না পড়িয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক পদ্ধতির
সাহায্যে পাঠদান করলে প্রতিটি শিক্ষার্থীর স্বকীয়তা বজায় থাকে এবং তারা নিজ নিজ
ক্ষমতা অনুযায়ী শেখার সুযোগ পায়।
মানবজীবনের
গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হল আত্মোপলদ্ধি । আত্মোপলদ্ধি দ্বারাই ব্যক্তির মধ্যে
পরিপূর্ণতা আসে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে এই কাজটি (আত্মোপলদ্ধি) সহজেই সম্পন্ন করা যায়।
ব্যক্তির
দ্বারা সমাজ গঠিত হয়। তাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির উন্নতি ঘটলে
সমাজেরই উন্নতি হবে।
শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক
লক্ষ্যের অসুবিধা বা ত্রুটি
এই সুবিধাগুলি
সত্বেও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে দেখা যায়, এর অনেক দুটিও আছে। এগুলি হল—
অতিরিক্ত
মাত্রায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যক্তিকে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক করে তােলে।
ব্যক্তি তখন সমাজের কল্যাণের পরিবর্তে ব্যক্তিগত কল্যাণকে বড়ো করে দেখে।
ব্যক্তিকেন্দ্রিক
শিক্ষায় ব্যক্তিকে সর্বপ্রকার স্বাধীনতা দেওয়া হয়। কিন্তু অনেক সময় ব্যক্তি
অনভিজ্ঞতার কারণে কি করণীয় বা করণীয় নয় তা বুঝে উঠতে পারে না বা ভুল সিদ্ধান্ত
নেয়, যার ফলে
ব্যক্তির ক্ষতি হয়।
সম্পূর্ণভাবে
ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষা অসম্ভব। ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষা সমাজের মধ্যেই ঘটে, তাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষা পরোক্ষভাবে সমাজের ওপর নির্ভরশীল।
ব্যক্তিকেন্দ্রিক
লক্ষ্যের সমর্থনে মনোবিজ্ঞানের যে তত্ত্ব রয়েছে তা ত্রুটিমুক্ত নয়। কারণ ব্যক্তি ও সমাজপরিবেশের
মিথস্ক্রিয়ার ফলেই ব্যক্তিত্বের বিকাশ সম্ভব হয়।
প্রত্যেকের
জন্য পৃথক শিক্ষা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং জটিল।
শিক্ষার
ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিকাশের সুবিধা ও অসুবিধাগুলির সাপেক্ষে এই কথা বলা যায় যে, কেবল ব্যক্তিকেন্দ্রিক লক্ষ্যের
মাধ্যমে শিক্ষার আধুনিক লক্ষ্যপূরণ তথা জাতীয় বিকাশ সম্ভব নয়।
No comments:
Post a Comment
Please do not enter any Link in the comment box.